সীতাদেবী হলেন মিথিলার রাজা জনকের পালিত কন্যা। অযোধ্যার মহারাজা দশরথের পুত্র রামের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল।
সীতা মিথিলা রাজ্যের রাজা জনকের কন্যা হওয়ায় তাকে জানকী নামে ডাকা হতো। এছাড়াও সীতাকে সিয়া, মৈথিলি, রমা, বৈদেহী ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হতো।
রামচন্দ্র ছিলেন অযোধ্যার মহারাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি অসাধারণ বীর এবং ধার্মিক যোদ্ধা ছিলেন।
মাতা কৈকেয়ীকে দেওয়া পিতা দশরথের বচন বা কথার সত্যতা রক্ষা করতে তিনি তাঁর স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষণ এর সঙ্গে ১৪ বছরের জন্য বনবাসে গিয়েছিলেন।
রামচন্দ্র ছিলেন অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র।তিনি অত্যন্ত ধার্মিক এবং বীর যোদ্ধা ছিলেন। তাঁর অন্য তিন ভাই হলেন ভারত, লক্ষণ ও শত্রুঘ্ন। রাম বনবাসে যাওয়ার পর ভারত রামচন্দ্রের পাদুকা কে সামনে রেখে ছোটভাই শত্রুঘ্নকে সঙ্গে নিয়ে ১৪ বৎসরের জন্য অযোধ্যার রাজকার্য দেখাশোনা করেছিলেন। এবং অপর ভাই লক্ষণ রামচন্দ্র এবং সীতার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে তাদের সাথে বনবাসে গিয়েছিলেন।
পঞ্চবটি বনে বসবাস করাকালীন রাক্ষসরাজ রাবণের প্রিয় বোন সুর্পনখার লক্ষণকে বিবাহ করার ইচ্ছে হয়। কিন্তু লক্ষণ তা প্রত্যাখ্যান করেন ও শাস্তি দেন। এই কথা রাবণ জানতে পেরে তাঁর প্রিয় বোনের অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য দেবী সীতাকে ছদ্মবেশে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন।
দেবী সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের প্রিয়তমা পত্নী। তিনি তাঁর স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সর্বদাই পাশে থাকতেন। বনবাসের সময় সীতার অনুরোধে সোনার হরিণ শিকার করতে গিয়ে রাম যখন ফিরে এসেছিলেন ততক্ষণে অসুরদের রাজা রাবণ সীতাকে ছদ্মবেশে হরণ করে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। রামচন্দ্র সীতাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে তাঁর দুঃখে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন। সর্বদাই তাঁর সীতার কথা মনে পড়ছিল, এবং নানান বিপদের আশঙ্কা হচ্ছিল। তাই তিনি দুঃখে কাতর হয়ে লক্ষণের কাছে বিলাপ করছিলেন।
চন্দ্রকলা অর্থে এখানে চন্দ্রমা বা চাঁদের কথা বলা হয়েছে।
পূর্ণিমা রাত্রে অসংখ্য তারার মাঝে চন্দ্রকলার বা চাঁদের অসাধারন সৌন্দর্য আমরা দেখতে পাই। রামের প্রিয়তমা পত্নী দেবী সীতা ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। তাই তিনি অসাধারণ সুন্দর চন্দ্রকলা বা চাঁদের সাথে সীতার তুলনা করেছিলেন।
আমরা দিনের বেলায় নীল আকাশের মাঝে সূর্যকে দেখতে পাই এবং রাত্রে অসংখ্য উজ্জ্বল তারার মাঝে চন্দ্রকে দেখতে পাই।
কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামের বিলাপ কবিতায় উল্লেখিত লাইনটির বক্তা হলেন রাম।
মন বুঝিবারে বলতে রাম বোঝাতে চেয়েছেন যে, জানকী (সীতা) কে হারিয়ে রামের মনের অবস্থা কি হয় - হয়তো সেটা দেখার জন্যই সীতা কোথাও লুকিয়ে আছেন।
জানকী হলেন রামের পত্নী সীতা।
সীতা ছিলেন মিথিলার মহারাজা জনকের পালিতা কন্যা। পিতার নাম থেকে কন্যার পরিচয় দিতে তাঁকে জানকী নামে ডাকা হয়। এটি একটি উপাধি, যা তাঁর বংশের পরিচয় প্রকাশ করে।
পৃথিবীর আপন দুহিতা হলেন রামের পত্নী সীতা।
পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, সীতা পৃথিবী থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মহারাজ জনক একটি যজ্ঞের ভূমিতে হাল চালানোর সময় মাটির নিচ থেকে সীতাকে পেয়েছিলেন। সেই জন্য সীতাকে পৃথিবীর কন্যা বা পৃথিবীর দুহিতা বলা হয়।
দেবী সীতার বিবাহ হয়েছিল অযোধ্যার মহারাজা দশরথের পুত্র রামের সঙ্গে। কিন্তু বনবাস কালে সীতাকে খুঁজে না পেয়ে মনের দুঃখ ও বেদনায় রামের মনে হয়েছে, পৃথিবী হয়তো আপন কন্যা সীতার দুঃখ কষ্টের কথা ভেবে নিজের কন্যা সীতাকে হরণ করে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন।
কৈকেয়ী হলেন অযোধ্যার রাজা দশরথের অন্যতমা পত্নী ও রামের মাতা।
কৈকেয়ীর ইচ্ছা ছিল অযোধ্যার রাজা হবে ভরত, এবং রাম ১৪ বছরের জন্য বনবাসে যাবে। বনবাসের মূল উদ্দেশ্য ছিল যাতে রাম আর কোনদিনই অযোধ্যায় না ফেরে। তাহলে ভরত চিরদিনই অযোধ্যার রাজা হয়ে থাকবে।
কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামের বিলাপ কবিতায় সীতাকে হারিয়ে রামের খেদোক্তি বিষয়ে আমরা জানতে পারি, কৈকেয়ীর মনের ইচ্ছা ছিল যে রাম যেন কোনদিনই আর অযোধ্যায় না ফেরে। সীতাকে পঞ্চবটি বনে হারিয়ে রামের মনে যে দুঃখ, হীনতা ও অপমানবোধ জেগেছিল তা নিয়ে তিনি হয়তো আর কোনদিনই অযোধ্যায় ফিরে আসতে পারবেন না। তাই তাঁর মনে এই রূপ ভাবনার উদয় হয়েছিল।
গোদাবরী একটি নদীর নাম। এই নদীর তীরে পঞ্চবটি বন অবস্থিত।
সীতাকে কমলমুখী বলা হয়েছে।
কমলের মত মুখ যার তাকে কমলমুখী বলা হয়। আলোচ্য কবিতায় রাম সীতাঁর মুখের সৌন্দর্যের সাথে কমল তথা পদ্মফুলের তুলনা করে তাকে কমলমুখী বলেছেন।
রামের বিলাপ কবিতায় সীতার সম্পর্কে নানান বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন কমলমুখী, পদ্মমুখী, চন্দ্রকলা, রাজলক্ষ্মী, সৌদামিনী, কনকলতা।
আলোচ্য লাইন দুটি রাম বিলাপ করে লক্ষণকে বলেছেন।
পঞ্চবটি বনে সীতাকে হারিয়ে রাম বিলাপ করতে শুরু করেন। সেই সময় তাঁর মনে সীতার সম্পর্কে নানা দুশ্চিন্তার উদয় হতে থাকে। সেই চিন্তা থেকেই রাম আলোচ্য লাইন দুটি বলেছেন।
সমুদ্র মন্থনের সময় ছদ্মবেশে রাহুর মুখে অমৃত ঢালায় বিষ্ণু চক্র দ্বারা তার গলা কেটে দেন। এখন তার গলার নিচের অংশের মৃত্যু ঘটলেও গলার উপরের অংশ অমর হয়ে যায়। এর ফলে রাহু যা কিছু খায় সবই তার গলা দিয়ে বের হয়ে যায়। তার ক্ষুধা কখনোই কমেনা। তাই কবিতায় রাহুকে চিরদিন পিপাসিত অর্থাৎ সারা জীবনেই তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত বলা হয়েছে।
কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামের বিলাপ কবিতায় সীতাকে হারিয়ে রামের খেদোক্তি বিষয়ে আমরা জানতে পারি। সমুদ্রমন্থনের সময় রাহুর ছদ্মবেশের বিষয়টি চন্দ্র ও সূর্য ভগবান বিষ্ণুকে জানিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ রাহুর এইরকম অবস্থা। তাই প্রতিশোধ নিতে রাহু মাঝে মাঝেই চন্দ্র ও সূর্যকে গ্রাস করে। তাই রাম বিলাপের সময় বলেছিলেন রাহু হয়তো সীতাকে ভুলবশত চন্দ্রকলা ভেবে গ্রাস করেছে। তাই তিনি সীতাকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
সীতাকে না খুঁজে পেয়ে রামের মনে বিভিন্ন রকম দুশ্চিন্তার উদয় হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে রাম আলোচ্য লাইনটি বলেছেন।
সৌদামিনী শব্দের অর্থ বিদ্যুৎ।
কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামের বিলাপ কবিতায় আমরা আলোচ্য লাইনটির বর্ণনা পাই। সীতাকে হারিয়ে রাম লক্ষণের কাছে বিলাপ করতে থাকেন। তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে বলেন, ঘন কালো মেঘ যেমন বিদ্যুৎ কে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি এই ঘন গভীর পঞ্চবটি বন হয়তো সীতাকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে অর্থাৎ সীতা গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেছেন। তাই তিনি তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
পঞ্চবটি বনে সীতাকে হারিয়ে রাম বিলাপ করতে শুরু করেন। নিজের মানসিক অবস্থার কথা বলতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে আলোচ্য লাইন দুটি তিনি বলেছেন।
তারা পদটি এখানে সর্বনাম পদ। তারা বলতে এখানে চন্দ্র, সূর্য ও অন্যান্য উজ্জ্বল নক্ষত্রদের কথা বলা হয়েছে।
আলোচ্য লাইনটির বক্তা হলেন রাম। এখানে তিমির আমার বলতে সীতাকে হারিয়ে তাঁর মনে যে অন্ধকার তথা দুঃখ কষ্টের সৃষ্টি হয়েছে, তার কথা বলা হয়েছে।
কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামের বিলাপ কবিতায় সীতাকে হারিয়ে রাম যে খেদোক্তি করতে শুরু করেছিলেন সে বিষয়ের বর্ণনা পাই। রামের ধ্যান-জ্ঞান, সুখ-দুঃখ সবকিছুতেই সীতা জুড়ে রয়েছেন। সীতা ছাড়া তিনি যেন মনিহারা ফনী। রাম আক্ষেপ করে বলেছেন সীতাকে হারিয়ে তাঁর মনে যে অন্ধকার তথা দুঃখ কষ্টের সৃষ্টি হয়েছে তা সূর্য, চন্দ্র ও সমস্ত নক্ষত্ররা আলো দিলেও দূর হবে না।
সীতাদেবী কে হারিয়ে রাম তাঁর ভাই লক্ষণ এর কাছে তাঁর মনের নানান আশঙ্কা এবং গভীর শোকের কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি বিলাপ করতে করতে লক্ষণকে অনুরোধ করেছেন যে সীতা দেবী কোথায় যেতে পারেন তা নির্ধারণ করতে এবং খুঁজে দেখতে। কেননা সীতাদেবী কে হারিয়ে রাম নিজেকে মনিহারা ফণীর সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং সর্বদাই তাঁর সীতার কথা মনে পড়ছে।
প্রথমে তিনি ভাবেন, সীতা হয়তো নিজে কোথাও লুকিয়ে আছেন। এরপর তাঁর মনে হয়, কোনো মুনিপত্নীর সহিত সীতা বনে বেড়াতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন অথবা বন তাকে লুকিয়ে রেখেছে। তিনি গোদাবরীর তীরে পদ্মবনের কথা ভাবেন, হয়তো পদ্মালয়া পদ্মাবতী সীতাকে সেই পদ্মবনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন। তাঁর মনে হয়, হয়তো দানব রাহু সীতাকে চন্দ্রকলা মনে করে গ্রাস করে ফেলেছে। এমনকি তিনি সীতার হারিয়ে যাওয়াকে কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্রের ফল বলেও ভাবেন। প্রতিটি অনুমানে রামের শোক ও সীতার প্রতি তাঁর গভীর প্রেম ফুটে ওঠে।
'রামের বিলাপ' কবিতাটি অবলম্বনে সীতার অন্তর্ধান সম্পর্কে রামচন্দ্রের অনুমানগুলি বিবৃত করো।কৃত্তিবাস ওঝার লেখা রামের বিলাপ কবিতায় সীতার অন্তর্ধান নিয়ে রামচন্দ্র বিভিন্ন অনুমান করেছিলেন। প্রথমে তিনি ভাবেন, সীতা হয়তো নিজে কোথাও লুকিয়ে আছেন। এরপর তাঁর মনে হয়, কোনো মুনিপত্নীর সহিত সীতা কোথাও চলে গেছেন। তিনি গোদাবরীর তীরে কমল-কানন ও পদ্মবনের কথা ভাবেন, হয়তো পদ্মালয়া পদ্মাবতী সীতাকে সেই পদ্মবনের মধ্যে কেউ লুকিয়ে রেখেছেন। তাঁর মনে সন্দেহ জাগে, হয়তো দানব রাহু সীতাকে চন্দ্রকলা মনে করে গ্রাস করে ফেলেছে। এমনকি তিনি সীতার হারিয়ে যাওয়াকে কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্রের ফল বলেও ভাবেন। প্রতিটি অনুমানে রামের শোক ও সীতার প্রতি তাঁর গভীর প্রেম ফুটে ওঠে।
দেবী সীতা হলেন মিথিলার মহারাজ জনকের কন্যা তাই এখানে তাকে জনকদুহিতা বলা হয়েছে।
কনক লতা অর্থে এখানে স্বর্ণলতা উদ্ভিদের কথা বলা হয়েছে। যার বর্ণ হলো সোনার মতো এবং অত্যন্ত মোলায়েম ও তন্বী। সীতার গায়ের রং ছিল ঠিক এই স্বর্ণলতার মতোই উজ্জ্বল। তাই রামচন্দ্র সীতাকে কনক লতা বা স্বর্ণলতার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
এখানে প্রায় শব্দটি স্বর্ণলতার সঙ্গে সীতাদেবীর তুলনা করতে ব্যবহার করা হয়েছে।